ইউক্রেন যুদ্ধে ভর করে রমরমা ইউরোপের অস্ত্রশিল্প

যুদ্ধ এখন এক বড় শিল্পে পরিণত হয়েছে। আর অস্ত্র শিল্পের বেড়ে ওঠার জন্য যুদ্ধ আবশ্যক। ইউক্রেন যুদ্ধ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে। যুদ্ধ শুরুর কয়েক মাস আগেও কেউ হয়তো ভাবতে পারেননি যে, ইউরোপে অস্ত্র শিল্প এতটা ফুলে ফেঁপে উঠবে। যেখানে ইউরোপের অনেক অস্ত্র নির্মাতা ও বিক্রেতা কোম্পানি অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে রীতিমতো ধুঁকছিল। এমন অবস্থায় ইউক্রেনে রাশিয়ার কথিত বিশেষ অভিযান শুরু হয় গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে। পরিস্থিতি বদলে যায় রাতারাতি। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ইউরোপের দেশগুলো সামরিক খাতে ব্যয় বাড়াচ্ছে ব্যাপকহারে। বিনিয়োগকারীরা নতুন করে আগ্রহী হন অস্ত্র শিল্পের প্রতি। 

স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর ইউরোপে যে আপাত শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করছিল, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তাতে ছেদ পড়ে। অস্ত্র কোম্পানিগুলো এত দিন একভাবে চললেও ভবিষ্যতে তারা উচ্চ মুনাফা করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ যুদ্ধ অচিরেই শেষ হওয়ার কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না। দ্য ইকোনমিস্টে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ইউরোপের অস্ত্র কারখানাগুলোয় ক্রয়াদেশ নতুন উচ্চতায় উঠেছে। স্নায়ুযুদ্ধের পর ইউরোপের অস্ত্র ক্রয়প্রবণতা কমে যায়। পাশাপাশি কমতে থাকে প্রতিরক্ষা বাজেট ও সমরাস্ত্রের উৎপাদন। তবে সম্প্রতি সে শিল্প ফের গতি পেয়েছে। অনেক দেশের সরকারই সমরাস্ত্র কারখানাগুলোয় কার্যাদেশ পাঠাচ্ছে।

জার্মান অস্ত্র কোম্পানি রাইনমেটাল ১০ আগস্ট এক প্রতিবেদনে জানায়, ২০২৩ সালের প্রথমার্ধে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় অস্ত্র বিক্রি বেড়েছে ১২ শতাংশ। চলতি বছর বিক্রয় প্রবৃদ্ধি ২০-৩০ শতাংশে উন্নীত হবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এই কোম্পানির শেয়ারের দাম প্রায় তিন গুণ হয়েছে। গত বছর বিশ্বের সামগ্রিক সামরিক বাজেট ৩.৭ শতাংশ বেড়ে ২.২ ট্রিলিয়ন বা ২ লাখ ২০ হাজার কোটি ডলারে উন্নীত হয়। রাশিয়ার সীমান্তবর্তী দেশগুলোয় বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি। ফিনল্যান্ডের বেড়েছে ৩৬ শতাংশ, লিথুয়ানিয়ার ২৭ শতাংশ, সুইডেনের ১২ শতাংশ ও পোল্যান্ডের ১১ শতাংশ। ইউরোপের বৃহত্তম অর্থনীতি জার্মানিও এ ক্ষেত্রে তৎপর হয়ে উঠেছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে জার্মান সরকার সামরিক বাজেট বাড়ানোর ঘোষণা দেয়। সেখানে সামরিক বাজেট জিডিপির ১.৪ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ২ শতাংশে উন্নীত করা হয়। সেই সঙ্গে সামরিক বাহিনীর জন্য ১১০ বিলিয়ন বা ১১ হাজার কোটি ডলারের বিশেষ তহবিল ঘোষণা করা হয়। 

জার্মানির সরকারি উপাত্তের বরাত দিয়ে আনাদোলু এজেন্সির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২২ সালে জার্মানি মোট ৮৯০ কোটি ডলারের অস্ত্র রপ্তানি করে। এর মধ্যে শুধু ইউক্রেনেই রপ্তানি হয় ২৪০ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র। ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাতা কোম্পানি এমবিডিএর ব্রিটিশ শাখা পোল্যান্ডের কাছ থেকে ২৪০ কোটি ডলারের কার্যাদেশ পেয়েছে। জুনে ফরাসি অস্ত্র কোম্পানি সাফরান গ্রিসের আর্মির কাছে বেশ কয়েকটি কৌশলী ড্রোন বিক্রি করেছে। রাইনমেটাল প্রায় ৬০০ কোটি ইউরোর বিনিময়ে জার্মান ও ডাচ সরকারকে তিন হাজার উড্ডয়ন সক্ষম যান সরবরাহ করবে। 

ইউরোপীয় সরকার এরই মধ্যে প্রতিরক্ষা কেনাকাটা আরও নির্বিঘ্ন করার ব্যবস্থা নিয়েছে। নভেম্বরে স্পেন ও জার্মানি ইউরোপের জন্য যুদ্ধবিমান তৈরিতে চুক্তি করেছে। ইউরোপের প্রতিরক্ষা বিষয়ক শিল্পের মধ্যে সমন্বয় এলে পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে। অস্ত্র কোম্পানিগুলো এত দিন একভাবে চললেও ভবিষ্যতে তারা উচ্চ মুনাফা করবে বলে মনে করছে। সমরাস্ত্র শিল্পের মধ্যস্থতাকারী জর্জ ঝাও বলেন, ‘প্রতিরক্ষা বাজেট মূলত ভূ-রাজনৈতিক হুমকির সঙ্গে পরিবর্তিত হয়।’ এখন অনেক দেশের সরকার রাশিয়াকে হুমকি মনে করছে, সে কারণে সমরাস্ত্র কারখানাগুলোয় এত বেশি কার্যাদেশ আসছে। 

অতিরিক্ত অস্ত্র উৎপাদন করতে গিয়ে রাইনমেটাল গত বছর দুই হাজার নতুন কর্মী নিয়োগ দিয়েছে এবং তাদের আরও কর্মী নিয়োগের পরিকল্পনা আছে। অন্যদিকে রাইনমেটালের প্রতিদ্বন্দ্বী সুইডিশ কোম্পানি সাব এক হাজার নতুন কর্মী নিয়োগ দিয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর অস্ত্রের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় পোল্যান্ড ও চেক প্রজাতন্ত্রের অস্ত্র কোম্পানিগুলো নতুন কর্মী নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করতে যাচ্ছে। একই সঙ্গে তারা এই শিল্প সম্প্রসারণের লক্ষ্যে নানা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।

চেক প্রজাতন্ত্রের অস্ত্র কোম্পানি এসটিভি গ্রুপের চেয়ারম্যান ডেভিড হ্যাক বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানান, কোম্পানির সবচেয়ে বড় কারখানা প্রাগ থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে পোলিকায় অবস্থিত। সেখানকার কাছাকাছি এক শহরে কোম্পানির অর্থায়নে শ্রমিকদের জন্য অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণ করা হবে। এমনকি এসটিভি গ্রুপ অবসরপ্রাপ্ত কর্মীদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চায়। অবসরপ্রাপ্ত কর্মীদের জন্য ক্যানটিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে, যেখানে তাদের জন্য বিনামূল্যে খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে। এসব কর্মী সোভিয়েত যুগের গোলাবারুদ উৎপাদনের অভিজ্ঞতা দিয়ে বর্তমান শ্রমিকদের সহায়তা করবেন।

চেক প্রজাতন্ত্রের ডিফেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (ডিএসআইএ) প্রেসিডেন্ট ও নির্বাহী পরিচালক জিরি হাইনেক বলেন, পর্যাপ্ত শ্রমিক পাওয়া না গেলে ইউরোপের বাইরেও উৎপাদন শুরু হতে পারে। তবে পর্যাপ্ত শ্রমিক ও উপকরণ পেলে চেক কোম্পানিগুলো ২০ শতাংশ পর্যন্ত উৎপাদন বাড়াতে পারবে।

পোল্যান্ডের সামরিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ডব্লিউবি গ্রুপ গত বছর বড় পরিসরে নারী কর্মীদের নিয়োগ দিতে শুরু করে। সংস্থাটি দুই হাজারের বেশি কর্মী নিয়োগ করেছে এবং গত বছর ১৫০ মিলিয়ন ডলার আয় করেছে। তারা মানবহীন ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র সিস্টেম উৎপাদন করে। প্রতিষ্ঠানটির মুখপাত্র বলেন, ‘অর্ডার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের উৎপাদন ব্যবস্থা পরিবর্তন করতে হয়েছে।’

যুক্তরাজ্যভিত্তিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এডিএস গ্রুপের প্রধান অর্থনীতিবিদ অ্যামি স্টোন বলেছেন, অস্ত্র নির্মাতা কোম্পানিগুলো কর্মী নিয়োগ নিয়ে চিন্তিত। প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলোর মধ্যে প্রতিভাধর কর্মী নিয়ে কাড়াকাড়ি বাড়ছে। সর্বশেষ নিয়োগের আগে থেকেই শূন্যপদ পূরণে হিমশিম খাচ্ছিল অস্ত্র কোম্পানিগুলো। গত বছরের শেষ দিকে ১০ হাজারটি শূন্যপদ ছিল।

স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসআইপিআরআই) মতে, ২০২২ সালে প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী ২৯টি দেশের মধ্যে পোল্যান্ড ও চেক প্রজাতন্ত্র অনেকটাই এগিয়ে। এসব দেশ যত অস্ত্র সরবরাহ করেছে, তার ২০ শতাংশেরও বেশি করেছে এই দুই দেশ। এর আগে এসআইপিআরআই আরেক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বদলে গেছে বিশ্বের অস্ত্র রপ্তানির হিসাবনিকাশ। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক রাশিয়ার অবিশ্বাস্য পতন ঘটেছে। আরও চাঙ্গা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বাজার। আমদানিকারক দেশের তালিকায় ওপরের দিকে উঠে এসেছে ইউক্রেন। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে অস্ত্র আমদানি কয়েক গুণ বাড়িয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটি অস্ত্র আমদানিতে বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে পৌঁছে গেছে। 

এসআইপিআরআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে ইউরোপের দেশগুলো অস্ত্র আমদানি বাড়িয়েছে ৪৭ শতাংশ। অন্যদিকে ইউরোপের ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো ওই পাঁচ বছরে অস্ত্র আমদানি বাড়িয়েছে ৬৫ শতাংশ। তবে এ সময় বিশ্বব্যাপী আমদানি সার্বিকভাবে ৫ শতাংশের বেশি কমেছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //